স্কিনকেয়ার মানেই দামি সিরাম বা ১০ ধাপের রুটিন নয় – আসল সৌন্দর্য আসে ধারাবাহিকতা ও স্মার্ট চর্চা থেকে। কিন্তু অনেক সময় যে কাজগুলো আমরা ভালো মনে করে করি, সেগুলোই হয়ত স্কিনের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে।
চলুন জেনে নিই ৬টি সাধারণ ভুল (skincare mistake) যেগুলো অনেকেই না বুঝেই করছেন আর সেগুলো কিভাবে এড়িয়ে চলা যায়।
১. স্কিনকেয়ারের অ্যাক্টিভগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করা
অ্যাক্টিভ উপাদানগুলো ধীরে ধীরে ব্যবহারের জন্য স্কিনকেয়ার সাইক্লিং ভালো কৌশল – কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এটি সঠিক ভাবে করতে পারেন না।
শক্তিশালী উপাদানগুলোকে ধীরে ধীরে রোজকার রুটিনে যোগ করার বদলে, অনেকে প্রতিদিন নতুন নতুন অ্যাক্টিভ ব্যবহার করেন।
একদিন রেটিনল, পরের দিন স্যালিসিলিক অ্যাসিড, তারপর নিয়াসিনামাইড… যার ফলে কোনোটাই নিয়মিত ব্যবহার হয় না, ফলাফল দেখার আগেই প্রোডাক্ট পরিবর্তন হয়ে যায়!
সমস্যা কী হয়?
- কোনো একটা উপাদান ত্বকে কাজ করার মতো সময়ই পায় না।
- যারা ভেবেছেন এটা “skincare cycling”, তারা ভুল ধারণা করে থাকেন। এইরকম অসামঞ্জস্যতা আসলে স্কিনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধান:
- একবারে মাত্র একটি অ্যাক্টিভ উপাদান ব্যবহার শুরু করুন।
- সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করে শুরু করুন, ধীরে ধীরে বাড়ান।
- ত্বক মানিয়ে নিলে, পরিপূরক উপাদানগুলো একসাথে বা আলাদা আলাদা দিনে ব্যবহার ভাবতে পারেন।
যেমনঃ এজলেয়িক অ্যাসিড (Azelaic acid) এবং নিয়াসিনামাইড ত্বকে সহজে মানিয়ে যায়, এমনকি প্রতিদিন ব্যবহার করলেও সমস্যা হয় না।
২. ভেপিং (Vaping) – আপনার ত্বকের গ্লো এর গোপন শত্রু
অনেকেই ভেপিং আর ত্বকের ক্ষতির মধ্যে সম্পর্কটা খুঁজে পায় না—কিন্তু এটা ত্বকের গ্লো নষ্ট করার এক নীরব ঘাতক!

ভেপিং ত্বকের কী ক্ষতি করে?
- রক্তনালীকে সংকুচিত করে, ত্বকে অক্সিজেনের সরবরাহ কমায়।
- কোলাজেন ও ইলাস্টিন ভেঙে ফেলে, যার ফলে বলিরেখা দেখা যায় আর ত্বক ঝুলে পড়ে।
- ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতার বাধা (Moisture barrier) নষ্ট করে, ত্বক হয়ে পড়ে নিষ্প্রাণ ও শুষ্ক।
ভেপিং দাঁতের মাড়ি আর হাড়েরও ক্ষতি করে, যা সময়ের সাথে মুখের বয়সের ছাপ আরও তরান্বিত করে।
মূল কথা:
যত দামি স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টই ব্যবহার করুন না কেন, ভেপিংয়ের কারণে শরীরের ভেতরে যে ক্ষতি হয়, তা সারানো কোনো প্রোডাক্টের পক্ষেই সম্ভব নয়।
ত্বক ভালো রাখার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর অভ্যাসও জরুরি।
৩. লেবু বা লেবুর রসের পর রোদে যাওয়া? সাবধান!
রোদে বসে লেবু ব্যবহার করতে গেলে বা রান্না করতে গেলে (বিশেষ করে লেবু, কমলার রস গায়ে লাগলে) ভয়ানক এক সমস্যা হতে পারে, যার নাম ফাইটোফটোডার্মাটাইটিস (phytophotodermatitis) – এর ফলে পোড়া দাগের মতো ত্বকে ছোপ পড়ে যায়।
কেন হয়?
লেবু জাতীয় ফলে ফুরোকুমারিন (Furocoumarins) নামের পদার্থ থাকে যা ত্বককে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির (UV) প্রতি অতি সংবেদনশীল করে তোলে।
এগুলো ত্বকে লেগে থাকা অবস্থায় রোদ লাগলে হতে পারে:
- ফোসকা পড়া ফুসকুড়ি
- ত্বক পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বালাপোড়া
- দীর্ঘস্থায়ী কালো দাগ (বিশেষ করে মাঝারি বা গাঢ় রঙের ত্বকে)
এটাকে কখনও কখনও মার্গারিটা বার্ন বলা হয়, কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও হালকা নয়!
অন্য ঝুঁকিপূর্ণ গাছ/ফল:
ডুমুর,পার্সনিপ (এক ধরনের মূলাজাতীয় সবজি),সেলারি (Celery), কুইন অ্যানিস লেস (বুনো ফুল/গুল্ম)।
ত্বককে কীভাবে সুরক্ষিত রাখবেন:
- লেবু জাতীয় ফল হাত দিয়ে ধরার পর হাত ভালো করে ধুয়ে ফেলুন
- রোদে খোলা জায়গায় লেবু/কমলার শরবত খাওয়া বা রান্না করা এড়িয়ে চলুন
- নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন, বিশেষ করে গরমের দিনগুলোতে
৪. রোদ + অ্যালকোহল = স্কিনের জন্য বিপদ
গরমে একটু রোদ আর এক গ্লাস ঠান্ডা পানীয় সাময়িকভাবে প্রশান্তি এনে দিলেও এটা হতে পারে আপনার ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ।
- অ্যালকোহল ত্বককে অতিবেগুনি রশ্মির প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে
- ত্বকের প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কমিয়ে দেয় যা ক্ষতি ঠেকায়
- সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমায়—ফলে সানস্ক্রিন আবার লাগাতে ভুলে যাওয়া বা ছায়ায় থাকার কথা মনে থাকে না।
- কোলাজেন ভাঙনের গতি বেড়ে যায়
- দাগ (পিগমেন্টেশন) আরও স্পষ্ট হয়
- ত্বকের টেক্সচার খারাপ হয়ে যায়, রুক্ষ হয়ে উঠতে পারে
করণীয়:
- অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন
- ব্রড-স্পেকট্রাম SPF 50+ সানস্ক্রিন অবশ্যই ব্যবহার করুন
- প্রতি ২ ঘন্টা পর পর সানস্ক্রিন আবার লাগান
- টুপি পরুন
- যতটা সম্ভব ছায়ায় থাকার চেষ্টা করুন
৫. রেটিনয়েড বা এসিড ব্যবহারের সময় ওয়্যাক্সিং
রেটিনয়েড আর এক্সফোলিয়েটিং এসিড ত্বকের উপরিভাগের কোষের রিনিউভাল বাড়িয়ে ত্বক মসৃণ করে। গ্লো বাড়ানোর জন্য ভালো হলেও ওয়্যাক্স করার জন্য একদমই নয়,এক্ষেত্রে স্কিন পিল হতে পারে!
কেন ঝুঁকিপূর্ণ?
- ত্বক অনেক বেশি মসৃণ হয়ে যায়, ওয়্যাক্স তখন শুধু চুল টানে না, সরাসরি ত্বকের টিস্যুও টেনে তোলে
- ত্বক ছিঁড়ে যাওয়া, ঘা বা মারাত্মক জ্বালাপোড়া হতে পারে
এটা শুধু রেটিনয়েডেই না, এসব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য:
- স্যালিসিলিক (Salicylic) বা গ্লাইকোলিক (Glycolic) এসিড ক্লিনজার
- বেনজইয়েল পারঅক্সাইড (Benzoyl peroxide)
- আইসোট্রেটিনয়েন (Accutane)
করণীয়:
- ওয়্যাক্স করার অন্তত ৫-৭ দিন আগে থেকে অ্যাকটিভ উপাদান ব্যবহার বন্ধ রাখুন
- আপনার এস্থেটিশিয়ানকে আপনার স্কিনকেয়ার রুটিন সম্পর্কে জানাতে হবে
- অ্যাকটিভ ব্যবহার করলে ওয়্যাক্সের বদলে থ্রেডিং বা শেভিংয়ের মতো অপশন বেছে নিন
৬. নিজে নিজে স্কিন ট্রিটমেন্ট শুরু করা
ব্রণ, র্যাশ বা দাগ দেখলেই অনেকেই নিজের মতো করে ওষুধ লাগিয়ে ফেলেন। কিন্তু যদি সেটা ভুল হয়, তাহলে ক্ষতি হতে পারে ভয়ানক।
যেমন: রিংওয়ার্মের (Ringworm) মতো ফাঙ্গাল ইনফেকশনে স্টেরয়েড ক্রিম ব্যবহার করা। এটি লক্ষণগুলো সাময়িক লুকিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু ইনফেকশনকে ভিতরে ভিতরে ছড়িয়ে দেয় আর সারাতেও কঠিন করে তোলে।
করণীয়:
- প্রতিটা ফুসকুড়ি বা ব্রণকেই তাৎক্ষণিকভাবে ট্রিট করতে যাবেন না
- মেয়াদহীন বা অন্যের প্রেসক্রিপশন প্রোডাক্ট ব্যবহার করবেন না
- কয়েক দিনের মধ্যে উন্নতি না দেখলে, ত্বক বিশেষজ্ঞের (ডার্মাটোলজিস্ট) পরামর্শ নিন
মাঝে মাঝে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হলো কিছু না করা—আপনার ত্বককে নিজে নিজে সেরে উঠতে সময় দিন।
শেষ কথা
ত্বকের সুস্থতা শুরু হোক স্মার্ট অভ্যাস থেকে:
- অ্যাকটিভ রুটিনকে জটিল করবেন না
- ভেপিং, অ্যালকোহল পান—এসব ক্ষতিকর অভ্যাস এড়িয়ে চলুন
- লেবু ধরলে বা অ্যাকটিভ ব্যবহার করলে ওয়্যাক্সিং নিয়ে সতর্ক থাকুন
- কোনো ট্রিটমেন্ট নেওয়ার আগে পেশাদার (ডার্মাটোলজিস্ট/স্কিন এক্সপার্ট) এর পরামর্শ নিন