ইন্টারনেট তথ্যের বিশাল ভান্ডার, কিন্তু এই বিশালতায় মিথ, ভুল বোঝাবুঝি আর অপ্রমাণিত তথ্যও ভেসে বেড়ায়। চুল পড়া বা চুল গজানো নিয়ে অনেকেই এমন সব ধারণায় বিশ্বাস করেন যেগুলোর পেছনে তেমন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
অনলাইন বা অফলাইনে, চুল নিয়ে এমন অনেক ভুল ধারণা মানুষের মনে গেঁথে যায়। আজকের আলোচনায় আমরা কয়েকটি প্রচলিত ভুল ধারণা কাটিয়ে উঠবো।
১. ক্রিয়েটিন সাপ্লিমেন্ট (Creatine Supplementation) এবং চুল পড়া
ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত ভুল ধারণা:
ক্রিয়েটিন খেলে DHT (Dihydrotestosterone) হরমোন বেড়ে যায়, আর তাতে চুল পড়ে।
বাস্তবতা:
এই ধারণাটি এসেছে একটিমাত্র গবেষণা থেকে, যেখানে রাগবি খেলোয়াড়দের অনেক বেশি ক্রিয়েটিন খাওয়ানো হলে তাদের রক্তে ডিএইচটি সাময়িকভাবে বেড়ে যায়।
ডিএইচটি একটি শক্তিশালী হরমোন যা চুলের গোড়া (ফলিকল) ছোট করে দিয়ে চুল পড়ার (এন্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেশিয়া) কারণ হতে পারে।

কিন্তু, পরবর্তীতে এই গবেষণার ফলাফল কখনোই পুনরায় প্রমাণিত হয়নি, গবেষণাটিতে বেশ কিছু ত্রুটিও ছিল (যেমন, শুরুতে সবার ডিএইচটি লেভেল সমান না থাকা)। তাছাড়া, ডিএইচটি-র বৃদ্ধিও ছিল খুব সামান্য।
আরও অনেক গবেষণা, এমনকি সম্প্রতি ১২ সপ্তাহের একটি বড় গবেষণায়ও দেখা গেছে, ক্রিয়েটিনের টেস্টোস্টেরন, ডিএইচটি, চুলের সংখ্যা বা ঘনত্বের উপর কোনো প্রভাব নেই।
এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয় যে ক্রিয়েটিন খেলে চুল পড়ে।
২. মিনোক্সিডিল ( Minoxidil) এর ব্যবহার আর ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া
ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত ভুল ধারণা:
ত্বকে বা মুখে মিনোক্সিডিল (টপিকাল বা ওরাল) ব্যবহার করলে কোলাজেন কমে যায়, ফলে ত্বকে বলিরেখা পড়ে বা ত্বক দ্রুত বুড়িয়ে যায়।
বাস্তবতা:
এই ভুল ধারণার পেছনে আছে একটি গবেষণা যেখানে দেখা গিয়েছিল মিনোক্সিডিল TGF beta নামের একটি গ্রোথ ফ্যাক্টর কমিয়ে দেয়, যা ফাইব্রোব্লাস্ট কোষের কোলাজেন তৈরির সাথে জড়িত।
অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে এতে গোটা ত্বকের কোলাজেন কমে যাবে। TGF beta কমে যাওয়া চুলের গোড়ায় ফাইব্রোসিস (অনাকাঙ্ক্ষিত টিস্যু জমা) কমাতে সাহায্য করে, যা চুল পড়া রোধে বরং উপকারে আসতে পারে!
মিনোক্সিডিল দশকের পর দশক ধরে নিরাপদেই ব্যবহৃত হচ্ছে, এর সাথে ত্বকে ভাঁজ বা বলিরেখা বেড়ে যাওয়ার কোনো যোগসূত্র নেই।
মুখে খাওয়ার মিনোক্সিডিল (ওরাল) শরীরে পানি ধরে রাখতে পারে, যার ফলে সাময়িকভাবে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল বা ফোলাভাব দেখা দিতে পারে – কিন্তু ওষুধ বন্ধ করলে বা ডোজ কমালেই এটি ঠিক হয়ে যায়।
মুখে খাওয়ার মিনোক্সিডিলের সাথেও কোলাজেন কমা বা দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই।
৩. Vitamin A derivatives (ট্রেটিনয়িন, এডাপালিন, রেটিনল) চুল গজায়?
ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত ভুল ধারণা:
ট্রেটিনয়িন, এড্যাপলেন বা রেটিনল মাথায় লাগালে চুল গজায়।
বাস্তবতা: অনেকেই ভাবেন, যেহেতু ভিটামিন এ ত্বকের কোষকে রিনিউ করে এবং প্রদাহ কমায়, তাই এগুলো চুল পড়া কমাতে বা চুল গজাতে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু, এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণায় প্রমাণ করতে পারেনি যে শুধুমাত্র এইগুলো স্ক্যাল্পে লাগালে চুলের বৃদ্ধি বা ঘনত্ব বাড়ে।
একটি ছোট গবেষণায় দেখা গিয়েছিল ট্রেটিনয়িন হয়তো মিনোক্সিডিলের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে (ত্বকে মিনোক্সিডিল শোষণ ও সক্রিয় করতে সাহায্য করে), কিন্তু এই তথ্যও প্রাথমিক পর্যায়ের।
চুল পড়ার চিকিৎসায় স্ক্যাল্পে এই ভিটামিন এ ডেরিভেটিভস ব্যবহারের জন্য কোনো স্বীকৃত পদ্ধতি বা নিয়মাবলী নেই। এগুলো ব্যবহারে তেমন ক্ষতি না হলেও, চুল পড়া রোধে এগুলোর নিয়মিত ব্যবহারের পক্ষে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা স্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
৪. চুল পড়লে প্রিন্যাটাল ভিটামিন (Prenatal Vitamins) খেতে হবে?
ক্ষেত্রবিশেষে প্রচলিত ভুল ধারণা:
মেয়েদের চুল পড়লে প্রিনেটাল ভিটামিন খাওয়া উচিত।
বাস্তবতা:
প্রিন্যাটাল ভিটামিন গর্ভবতী নারী বা গর্ভধারণের পরিকল্পনা করা নারীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আয়রনের ঘাটতি (যা চুল পড়ার কারণ হতে পারে) রোধ করতে।
গর্ভাবস্থায় চুলের বৃদ্ধি চক্রের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে – গর্ভাবস্থায় চুল বাড়ে বেশি, আর ডেলিভারির পর অনেক চুল পড়ে। কিন্তু, গর্ভবতী নন এমন মহিলাদের চুল পড়া কমাতে অসামঞ্জস্যভাবে প্রিন্যাটাল ভিটামিন খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া ঠিক নয়।
চুল পড়ার কারণ অনেক রকম হতে পারে। প্রয়োজন ছাড়াই, বিশেষ করে আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেলে শরীরে আয়রনের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যেতে পারে (আয়রন ওভারলোড), যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বাজারে থাকা প্রিন্যাটাল ভিটামিনগুলোর গুণমান ও মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন।
তাই, বিশেষ করে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া মহিলাদের প্রিন্যাটাল ভিটামিন খাওয়া উচিত নয়।
৫. শ্যাম্পু ব্যবহার চুল পড়া বৃদ্ধি করে
ক্ষেত্রবিশেষে ভুল ধারণা:
শ্যাম্পু করলে চুলের গোড়া (ফলিকল) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর শ্যাম্পু করা বন্ধ করলে চুল ভালোভাবে গজাবে।
বাস্তবতা:
নিয়মিত শ্যাম্পু করা আসলে স্বাস্থ্যকর চুল গজানোর জন্য উপকারী।
মাথার তালুর তেল জমে অক্সিডাইজড হয়ে যেতে পারে, যা ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ম্যালাসেজিয়া নামের ইস্টের (ছত্রাক) বৃদ্ধি বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ড্যানড্রাফ এবং স্ক্যাল্পে প্রদাহ হতে পারে, যা চুল পড়া আরও বাড়িয়ে দিতে পারে!
শ্যাম্পু করার সময় মাথার তালুতে হালকা ম্যাসাজ হয়, যা চুলের গোড়ায় রক্ত চলাচল বাড়ায় – চুলের স্বাস্থ্যের জন্য এটি খুবই জরুরি। এছাড়া, শ্যাম্পু করলে টেলোজেন ফেজে থাকা চুল (যে চুলগুলো পড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত) সহজেই ঝরে যায়। এগুলো জমে না থাকায় পরে হঠাৎ করে অনেক বেশি চুল পড়ার মতো মনে হয় না।
যারা শ্যাম্পু করা বন্ধ রাখেন, তারা আবার শ্যাম্পু শুরু করলে এই জমে থাকা চুলগুলো একসাথে ঝরে পড়তে দেখেন – মনে করেন শ্যাম্পু করাতেই চুল বেশি পড়ছে।
প্রতিদিন শ্যাম্পু করা সবার চুলের ধরণ অনুযায়ী জন্য ভালো নাও হতে পারে, তবে সপ্তাহে অন্তত একবার শ্যাম্পু করা উচিত। কিছু শ্যাম্পুতে এমন সক্রিয় উপাদান থাকে যা চুলের গোড়া ও চুলের বৃদ্ধিকে সত্যিই সাহায্য করে।
শেষ কথা
চুল পড়া ও বৃদ্ধি নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো – যেমন ক্রিয়েটিন, মিনোক্সিডিল, ভিটামিন এ ডেরিভেটিভস, প্রিন্যাটাল ভিটামিন এবং শ্যাম্পু সংক্রান্ত মিথগুলো – বেশিরভাগই ভুল বোঝাবুঝি, একটিমাত্র গবেষণার অপব্যাখ্যা বা শুধু মাত্র সম্পর্ক দেখে ধারণা করার ফলাফল; শক্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ভিত্তিতে নয়।
বর্তমান গবেষণা নির্দেশ করে যে, সঠিক কারণ নির্ণয় ছাড়া সাপ্লিমেন্ট নেওয়া ঠিক নয়। অন্যদিকে, স্ক্যাল্পের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নিয়মিত শ্যাম্পু করা উচিত। অনলাইনে চুল পড়া নিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তার যথাযথ যাচাই করে দেখার সচেতনতাই চুলের সঠিক ও নিরাপদ যত্নের চাবিকাঠি।